আত্মহত্যা: বাংলাদেশে ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিজের হাতেই নিজের জীবন নিয়েছেন, বলছে গবেষণা

0 19

ভুক্তভোগী-১

বাংলাদেশের একটি গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মিসবাহ (ছদ্মনাম) ঢাকার অদূরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করা মিসবাহর কথায় কিছুটা আঞ্চলিকতার টান ছিল, শারীরিকভাবেও তিনি ছোটখাটো গড়নের। আর তার এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে মিসবাহকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধু-বান্ধবরা সবসময়ই ঠাট্টা-তামাশা করতো। একটা সময় তার শিক্ষকরাও তার শারীরিক গঠন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি – এমনকি তার পোশাক নিয়েও ঠাট্টা করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় মিসবাহ তার ভাড়া বাসার পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

তার আত্মহত্যার চেষ্টার কারণ নিয়ে কথা বলার সময় মিসবাহ বলছিলেন: “শুরুর দিকে বুঝতাম না যে ওরা আসলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। আমি যাদের বন্ধু মনে করে ছুটে যেতাম, কিছুদিন পর দেখলাম ওরা আসলে আমার উচ্চারণ, আমার পোশাক নিয়ে মজা করছে। আমার প্রতিটি কথায় তারা তাচ্ছিল্য করতো।”

“একটা সময় এমন অবস্থা হল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়রদের বা নতুন কারো সাথে পরিচিত হওয়ার সময়ও আমাকে তাচ্ছিল্য করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই জুনিয়ররাও কিছুদিন পর থেকে আমার সাথে একই রকম ব্যবহার করা শুরু করে।”

“তৃতীয় বর্ষে একজন শিক্ষক তার ক্লাসেও একই ধরনের ঠাট্টা করা শুরু করলেন, আমার বন্ধুরাও তাঁর সাথে যোগ দেয়। তখন একটা পর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেই।”

সৌভাগ্যজনকভাবে মারা যাননি মিসবাহ। ঘাড়ে ও হাতে আঘাত পেলেও কিছুদিনের মধ্যে তিনি সেরে ওঠেন।

ভুক্তভোগী-২

গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে মালিহা (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছেন ২০১৮ সালে। অনার্স শেষ করার পর মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে পরিবারের কথা চিন্তা করে চাকরি খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন। বিসিএস পরীক্ষার পাশাপাশি আরো কয়েকটি জায়গায় নিয়োগ পরীক্ষাও দেন তিনি। কিন্তু কোথাও উত্তীর্ণ হতে পারেন নি।

এর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সব নিয়োগ পরীক্ষা। মালিহা গ্রামে পরিবারের কাছে ফিরে যান । সেখানে কয়েকমাস থেকে উপলব্ধি করেন যে তার কাছ থেকে তার পরিবারের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মা অনেকটা যেন অপেক্ষাই করে বসে আছেন যে, কবে মালিহা চাকরি পাবে আর সংসারের হাল ধরবে।

শেষ পর্যন্ত গত বছর তৃতীয়বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েও যখন প্রাথমিক পর্যায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নি, তখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মালিহা।

তিনি বলছিলেন, “বাবা-মা একটা সময়ে আর ধৈর্য ধরতে না পেরে কটু কথাই শোনাতে শুরু করেছিলেন। তাদেরও দোষ দেয়া যায় না। তাদের তো অনেক আশা ছিল যে, মেয়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে ভাল চাকরি পাবে, ছোট ভাইগুলোর খরচ বহন করবে।”

“সেটা তো হয়ই নি, বরং আমিই বাবা-মার ঘাড়ে গিয়ে বসি। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও তখন তাদের নানা ধরনের খোঁটা শুনতে হতো। সেরকমই একদিন আর সহ্য করতে পারিনি।”

মালিহা বলেন, পরিবারের সদস্যরা ছাড়া চাকরি না পাওয়ায় বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকেও সেসময় অপ্রত্যাশিতভাবে খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি।

আর সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিতদের সফলতার খবর দেখেও বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়তে থাকে তার।

“আমি যখন হতাশ, হয়ে, বিষণ্ণ ভাবে ঘরে বসে থাকতাম আর অনলাইনে চাকরি খুঁজতাম, তখন ফেসবুকে দেখতাম আমার বন্ধুদের অধিকাংশই সফলভাবে কিছু না কিছু করছে। সেগুলো দেখে মনে হতো, তাহলে বোধহয় আমিই কিছু পারি না, বাকিরা তো ঠিকই আছে,” বলছিলেন মালিহা।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেন আত্মহত্যার প্রবণতা?

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে এই ধরনের বিষণ্ণতার মধ্যে দিয়ে কখনো না কখনো দিন যাপন করেন। তাদের অনেকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন বা আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করেছেন।

শনিবার অলাভজনক একটি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৭৯ জন।

বাংলাদেশের জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই জরিপটি পরিচালনা করেছে সংস্থাটি।

জরিপে উঠে এসেছে যে, আত্মহত্যা করা ১০১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬২ জনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মোট আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের লকডাউনের সময় ঘরে বসে থাকা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা তৈরি হওয়া, পরিচিতদের সাথে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হওয়ার মত নানা কারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরির অন্যতম প্রধান কারণ, এবং এই বিষণ্ণতাই অনেককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে।

তবে এসব কারণ ছাড়াও বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মত ব্যবহার, পরিবারের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের অর্জনের খবরের সাথে নিজেদের অর্জনের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও হতাশার হার বাড়ছে – যেই বিষণ্ণতা ও হতাশা এক সময় তাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে।

দারিদ্র, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি আর সোশ্যাল মিডিয়া

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার হার বেশি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক – বলছিলেন বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কাউন্সেলিং দেয়া প্রতিষ্ঠান সাজিদা ফাউন্ডেশনের সাজিদা মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রুবিনা জাহান।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের হার বেশি। এই পরিপ্রেক্ষিতে রুবিনা জাহান বলেন, “কোভিডের সময় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে একটা ছেলে বা মেয়ে যখন টানা দেড়-দুই বছর তার ঘরে থেকেছে, তার পরিবারের জন্যই অনেকসময় তার ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঐ শিক্ষার্থী যদি হলে থাকতো, একটা টিউশনি করতো – তাহলে হয়তো তার নিজের জন্য একটা সাপোর্ট সিস্টেম থাকতো।”

এই ধরনের বিষণ্ণতার পাশাপাশি পরিবারের প্রত্যাশার চাপ, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা মিলিয়ে একটা পর্যায়ে অনেকে আত্মহত্যা করে, বলেন রুবিনা জাহান।

২০২১ সালে ২,৫৫২ জন শিক্ষার্থীর ওপর একটি জরিপ চালায় আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা যায় যে গ্রামের ৮৬ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই হার ৮৪ শতাংশ।

রুবিনা জাহান বলেন, পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নেতিবাচক প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিও মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরির অন্যতম কারণ।

“আমাদের সমাজের একটা ধারা আছে – কম প্রশংসা করা এবং বেশি দোষ খোঁজার চেষ্টা করা। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই চল রয়েছে।”

“এই যে একজন মানুষকে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য গ্রহণ করতে না পারা, সবসময় তুলনা করা, কোনকিছু নিজের ধারণা বা মন মতো না হলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা – অর্থাৎ একটা মানুষ হিসেবে একজনকে আমি কীভাবে বিচার করছি, তার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করছি – এই জায়গাটা থেকে একটা মানুষের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি হয়,” বলেন তিনি।

আর সোশ্যাল মিডিয়া ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষজন আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘সেলফ স্ক্রিনিং’ বা আত্ম-পর্যালোচনা করার কারণে মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন মিজ জাহান।

“আমরা আগে বাস্তব জীবনে যাদের সাথে মিশতাম, কথা বলতাম, সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের প্রত্যাশার মানদণ্ডটা তৈরি হত আমাদের মননে।”

“কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা এত কিছু দেখছি, যার ফলে অন্য একজন কী করছে তা দেখে আমি হয়তো নিজেকে বিচার করছি, বা আমার পরিবার আমাকে আরেকজন কী করছে তা দেখে বিচার করছে।”

“এই সেলফ স্ক্রিনিং যারা করে, তারা সবসময়ই উদ্বিগ্ন থাকে, কারণ তারা সবসময় মনে করতে থাকে যে ‘আমি যা, তা যথেষ্ট নয়।'”

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপেও উঠে আসে যে, যারা দিনে তিন থেকে সাত ঘণ্টা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাদের ৮৮ ভাগই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। – বিবিসি বাংলা

মন্তব্য করুন।

আপনার মেইল প্রকাশিত হবে না।