পাহাড়ি গ্রামটির যমজ বোনই এখন বাংলাদেশের আশার প্রদীপ

অনলাইন ডেস্ক

0 128

‘খুশি লাগে। ভালো লেগেছে।’

আপ্রমা মগিনির এ কথায় অফুরন্ত উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও ভালোবাসার জোয়ার। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা বলতে পারেন না। ফোনে অপর প্রান্ত থেকে যতটুকু বললেন, তাতেই পাওয়া যাচ্ছিল এক মায়ের সীমাহীন গর্ব। কাল তাঁর মেয়ে আনাই মগিনির একমাত্র গোলে ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব–১৯ নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। পাহাড়ে বসবাস করা পরিবারটিতে এমন উৎসবের রাত যে এর আগে কখনো আসেনি।

খাগড়াছড়ির সবুজে ঢাকা সাতভাইয়াপাড়া পাহাড়ি গ্রামে রোজকার মতোই ছুঁয়ে যায় মেঘ। কাল রাতে গ্রামটির বাড়িতে বাড়িতে ছিল উৎসবের আবহ। এই গ্রামেরই মেয়ে আনাই যে গোল করে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন। উজ্জ্বল করেছেন পাহাড়ি গ্রামটির নাম, গর্ব এনে দিয়েছেন এই পাহাড়ি জনপদে।

অথচ আনাই জন্ম নেওয়ার পর পরিবারটির কষ্টের দিন কেটেছে। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে সাতভাইয়াপাড়ায় বসবাস রিপ্রু ও আপ্রমা মগিনি দম্পতির। তিনবেলা পেট ভরে খাবার জো নেই, এমন পরিস্থিতিতে পরিবারটিতে আনাইয়ের জন্ম। নবজাতকের খাবার জোটানোই ছিল পরিবারটির কাছে চ্যালেঞ্জ।

শুধু আনাই নন, তাঁর যমজ বোন আনুচিং মগিনিও জাতীয় দলেরই খেলোয়াড় এবং তাঁর গল্পটাও একই। এক রোববার আনাই জন্ম নেওয়ার দুই মিনিটের ব্যবধানে আনুচিংয়ের জন্ম। অভাবী পরিবারে অপ্রত্যাশিতভাবে যমজ কন্যাসন্তান আসায় উৎসবের জায়গায় হতাশা বাসা বেঁধেছিল। কৃষক পরিবারে পাঁচটি মুখের সঙ্গে আরও দুটি নতুন মুখের সংযোজন। নিয়তির কী খেল! এই যমজ দুই বোনের কল্যাণেই পরিবারটি এখন আলোকিত। অভাব দূর হয়ে ফুটেছে সচ্ছলতার হাসি।

দুই বোনই কয়েক বছর ধরে খেলছেন জাতীয় দলে। একই সঙ্গে বয়সভিত্তিক দলেরও নিয়মিত মুখ। কাল ডিফেন্ডার আনাই খেললেও মাঠে নামা হয়নি স্ট্রাইকার আনুচিংয়ের। ফুটবল খেলে পরিবারের অভাব বেশ কয়েক বছর আগেই দূর করেছেন আনাই–আনুচিং। সবার দেখাশোনার জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছেন দুই বোন। ২০১৮ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব–১৬ বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে পা রেখেছিল বাংলাদেশ। গণভবনে ডেকে দলের প্রত্যেক সদস্যের হাতে ১০ লাখ টাকা করে তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই বোন পেয়েছেন একসঙ্গে ২০ লাখ টাকা—সেই টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে জমি।

অসচ্ছল পরিবারে অনেক কিছুর সঙ্গে যোগ হয়েছে টিভি। কাল সে টিভির সামনে বসেই মেয়ের খেলা দেখেছেন তাঁদের মা–বাবা। মা আপ্রমা মগিনি ভালোভাবে বাংলা বলতে না পারলেও বাবা রিপ্রু বাংলায় অভ্যস্ত। খাগড়াছড়ি থেকে কাল খেলা দেখার গল্পটা শোনালেন আনাইয়ের বাবা রিপ্রু, ‘মেয়েরা টিভি কিনে দিয়েছে। নিজের বাড়িতে খেলা দেখেছি। খুব আনন্দ লাগছে। খেলা শেষে গ্রামের লোকজন এসে বলেছে, মেয়েরা জিতেছে। খেলা দেখতে দেখতে ভাত–তরকারি রান্না হয়নি। অনেক রাতে রান্না করে খেয়ে ঘুমিয়েছি।’

দুই বোনের ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পের যাত্রাপথও এক। ২০১১ সালের বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে শুরু। খাগড়াছড়ি জেলায় মেয়েদের দল না থাকায় ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা দলের হয়ে খেলেছে দুই বোন। পরে ২০১৫ সালে খাগড়াছড়ি জেলা দলের হয়ে খেলেই তাঁরা জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলে।

পরের গল্পটা সবারই জানা। দুই বোন জাতীয় দলের পাশাপাশি খেলছেন বয়সভিত্তিক দলেও। ২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব–১৮ সাফ জয়ী দলেও ছিলেন তাঁরা। এখন সারা বছর ঢাকায় ক্যাম্পে থাকতে হয়। আজ এই দেশ, তো কাল অন্য দেশে। দুই বোনকে ছাড়া এখন বাংলাদেশ দলের কথা ভাবাই যায় না।

মেয়েদের খেলা থাকলেই দুই বোনের ছবি ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়। পত্রিকার পাতায় বড় বড় ছবি আসে। রিপ্রু ও আপ্রমা দম্পতির তখন নিশ্চয়ই গর্ব হয়। কে জানে, আনমনে হয়তো মা–বাবা বলে ওঠেন, একদিন যাদের আগমনে চোখে আঁধার দেখেছি, আজ তারাই আশার প্রদীপ।’ -প্র.আ.

মন্তব্য করুন।

আপনার মেইল প্রকাশিত হবে না।