বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার নাতিশীতোষ্ণ মাটির ঘর

মোঃ সোহাগ আরেফিন, গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি

0 230

বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার নামে খ্যাত চলনবিল। চলনবিলকে ঘিরে নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি নাতিশীতোষ্ণ ঘর হারিয়ে যাচ্ছে কালের বিবর্তনে। ঘরগুলোকে সাধারণ মানুষ এসি ঘর বলেও মনে করেন।

চলনবিলের অন্যতম অঞ্চল নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া,বাগাতিপাড়া,সদর,লালপুর ও নলডাঙ্গা, উপজেলার গ্রামগুলোতে গত কয়েক বছর আগেও নজরে পড়তো মাটির ঘরবাড়ী। প্রচুর গরম ও শীতে বসবাসের উপযোগী ছিলো এই মাটির ঘর।

যারা মাটির ঘরে অল্প সময় হলেও কাটিয়েছেন তারা জানেন মাটির এ ঘরে থাকার মজা। শুধু মাটির ঘরই নয় মাটির এ ঘর সংশ্লিষ্ট বাড়ীকে ঘিরে রাখার হয় মাটি দিয়ে তৈরি ওয়াল করেও। ফলে এসকল বাড়ীতে বাহিরের শব্দ দূষণ থেকেও বেঁচে থাকা যায়। প্রচন্ড শীতে যেমন ঘরে থাকেনা অতি ঠান্ডা তেমনি অতি গরমেও থাকে না গা ঘামানো পরিবেশ। অর্থাৎ শীত বা গরম সব সময়েই থাকা যায় স্বস্থির সাথে।

মাটির ঘর অত্যন্ত আরামদায়ক হলেও আধুনিকতায় ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর। মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন, পারিবারিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে এখন আর কেউ মাটির ঘরে থাকতে চান না। জানা যায়, একসময় নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলাতেই শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষেরই ছিল মাটির ঘর। আগের দিনের সেই দৃশ্য এখন পাল্টে গেছে।

মাটির ঘরের বিষয়ে গুরুদাসপুর উপজেলার প্রবীণদের কাছে থেকে জানা যায়, আগে ধারাবারিষা, নাজিরপুর, বিয়াঘাট, মশিন্দা, চাপিলা, খুবজিপুর ইউনিয়নের উদবাড়িয়া, শিধুলী, বেড়গঙ্গারামপুর, হামলাইকোল, মামুদপুর, মোল্লাবাজার, শিয়ানপাড়া, কাছিকাটা, হাঁসমারী, শিকারপুর, খামারপাথুরিয়া, বৃ- পাথুরিয়া, বিলশা, বালশা, রুহাইসহ বিভিন্ন গ্রামে ছিল মাটির ঘর।

ওইসব গ্রামের হাতেগোনা কিছু বাড়ীতে এখন মাটির ঘর থাকলেও অধিকাংশ বাড়ীতে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা ও সেমিপাকা ঘর। এলাকাবাসী জানান, উপজেলার যেসব জায়গায় লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পাওয়া যেত সেসব এলাকার লোকজনই বাড়িতে মাটির ঘর বানাতেন। লাল ও এঁটেল মাটি ভিজিয়ে প্রথমে নরম কাঁদা মাটিতে পরিণত করা হতো। কাঁদা মাটিকে বিশেষ পদ্ধতিতে আরও আঁঠালো করা হতো। গ্রাম বাংলায় একে পাঁক বলে।

সেই নরম কাঁদা মাটি দিয়ে তৈরি হতো ২থেকে ৩ ফিট চওড়া দেয়াল। প্রতিবার দুই-তিন ফুট উঁচু দেয়াল করে তা পাঁচ-ছয় দিন রোদে শুকানো হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে ১২-১৫ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হতো। পরে দেয়ালের ওপর টিনের চালা বা ছন দিয়ে ছাউনি করা হতো।প্রতিটি ঘর নির্মাণে সময় লাগত দুই-তিন মাস।

বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘরের ভিতরের দিকে ধানের তুষ দিয়ে দেয়ালের ওপর প্রলেপ দেওয়া হতো। বাইরের দিকে দেওয়া হতো চুনের প্রলেপ বা আলকাতরা। বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর শতাধিক বছর পর্যন্ত টিকে থাকত। শুধু একতলা নয় দোতলা ঘরও তৈরি করা হতো এ পদ্ধতিতে। উপরের তলায় সাধারণত শস্য রাখা হতো।

ধারাবারিষা ইউনিয়নের উদবাড়িয়া গ্রামের দেয়ালি (মাটির ঘর নির্মাণ কারিগর) ঝগর উদ্দিন জানান, মাটির ঘর তৈরির উপযুক্ত সময় কার্তিক মাস। কারণ এ সময়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে না।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রতি হাত ঘর নির্মাণে ১০ টাকা নিতাম। অনেক সময় ৫-৬ হাজার টাকা চুক্তিতেও ঘর নির্মাণ করে দিতাম। মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করে না। আমরা এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
উপজেলার ধারাবারিষা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ রোকনুজ্জামান বলেন, লাল ও এঁটেল মাটির অভাব, মাটির ঘর তৈরির কারিগর সংকটের কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করতে চায় না।
ধারাবারিষা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন বলেন, মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। তাই এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায় না।
মামুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ আবুল বাশার বলেন, ছোট বেলায় মাটির ঘরে থেকে যে সুবিধা বা আরাম পেতাম তা এক কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বললাম। বাকিটা বুঝে নেন।

তবে অনেকেই বলেন, বর্তমানে পাকা ইটের ঘর তৈরি করলেও আগের মতো শব্দ দূষণমুক্ত থাকা যায় না। তাছাড়া মাটির তৈরি ঘরে যে আরাম পাওয়া যেত বিশেষ করে গরমের সময় তা এখন পাওয়া যায় না।

মন্তব্য করুন।

আপনার মেইল প্রকাশিত হবে না।